বিশ্ব যখন অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশ এক দৃঢ় ও প্রতিশ্রুতিশীল অবস্থানে রয়েছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস জোর দিয়ে বলেছেন যে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় সাহসী সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছে, যা জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতার মধ্যে বাংলাদেশও নানা সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। ঋণের বোঝা বৃদ্ধি এবং মানবিক সংকট অনেক দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে, ফলে বৈশ্বিক উন্নয়নের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা আরও প্রকট হচ্ছে। ড. ইউনূস মনে করেন, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়ানো জরুরি, যাতে এই অঞ্চল অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সম্ভাব্য ঋণ সংকট থেকে রক্ষা পেতে পারে। বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের উচিত জরুরি সংস্কার কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নতুন উদ্ভাবনী সমাধানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের পথ সুগম করা।
সংস্কারের মাধ্যমে বিশ্বাস পুনর্গঠন
জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। এগুলো শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মূল চাবিকাঠি। ড. ইউনূস বলেন, এমন এক সময়ে যখন জনগণ সরকারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়ছে, তখন এই সংস্কারগুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। জনগণের মতামতকে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং অংশগ্রহণমূলক প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেওয়াই গণতন্ত্রকে সুসংহত করার অন্যতম উপায়। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার সংস্কার জনগণকে সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে, যা জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সহায়তা করছে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ু পরিবর্তন
বৈশ্বিক পণ্যমূল্যের অস্থিরতার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তাই বাংলাদেশকে দ্রুত অভিযোজনমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। ড. ইউনূস বলেন, এটি শুধু স্বল্পমেয়াদি সহায়তার বিষয় নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই পরিকল্পনার প্রয়োজন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তার ওপর জোর দেওয়া অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ কেবলমাত্র পরিবেশের জন্য উপকারী নয়, বরং এটি খাদ্য উৎপাদনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি খাতকে বাজারের ওঠানামা থেকে রক্ষা করা সম্ভব এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ
ড. ইউনূসের মতে, একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল ভিত্তি। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় বিনিয়োগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে ত্বরান্বিত করে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে এগিয়ে রাখবে। বিশেষ করে, ডিজিটাল শিক্ষা ও উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি তরুণদের দক্ষ করে তুলতে পারে, যা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অপরিহার্য।
এশিয়ার প্রযুক্তিগত ঝুঁকি মোকাবিলা
প্রযুক্তিগত উন্নতির পাশাপাশি নতুন ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। ড. ইউনূস সতর্ক করে বলেছেন যে, এশিয়ায় ডিজিটাল বিভাজন (Digital Divide) দ্রুত কমিয়ে আনা প্রয়োজন, যাতে প্রযুক্তির সুযোগগুলো পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় এবং সম্ভাব্য বিপদগুলো এড়ানো সম্ভব হয়। প্রযুক্তি-নির্ভর অর্থনীতির সুবিধা গ্রহণ করতে হলে সবাইকে এর আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার, ইন্টারনেট সুবিধা ও ডিজিটাল অবকাঠামোর উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি
বাংলাদেশ যদি একটি আত্মনির্ভরশীল ও স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে চায়, তাহলে কৃষিক্ষেত্রে টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। ড. ইউনূস মনে করেন, আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের কৃষিতে উদ্ভাবনী ধারণা প্রয়োগে উৎসাহিত করা গেলে এটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারে। পাশাপাশি, সামাজিক ব্যবসার মডেল প্রয়োগ করে স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা করা এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের পথ তৈরি করা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব কৃষি উদ্যোগকে উৎসাহিত করলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য ঐক্যের আহ্বান
বিশ্বব্যাপী সংঘাত ও অস্থিতিশীলতার কারণে কোটি কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, যা মানবিক সংকটকে আরও গভীর করছে। এশিয়ার আঞ্চলিক নেতাদের একত্রিত হয়ে এই সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে হবে। বিশেষ করে, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য কৌশলগত সহযোগিতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে টেকসই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা গেলে শুধু মানবিক সহায়তা বাড়ানো সম্ভব হবে না, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুযোগও সৃষ্টি হবে। একসঙ্গে কাজ করলে এশিয়া একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবে।
বিশ্বের জটিল বাস্তবতায় বাংলাদেশ তার রূপান্তরমূলক সংস্কার ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। শিক্ষা, টেকসই উন্নয়ন ও পারস্পরিক সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশটি যে অগ্রযাত্রা করছে, তা ভবিষ্যতের প্রতিকূলতাকে জয় করার পথ দেখাচ্ছে।
COMMENTS